প্রথম বনাম তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ
আমাকে লোকেরা জিজ্ঞেস করেন জাতীয়তাবাদ সম্পুর্কে আমার চিন্তা ভাবনা কেমন। তৃতীয় বিশ্ববাদি চিন্তার আলোকে বলতে পারি জাতীয়তাবাদ তৃতীয় বিশ্বের জন্য ভালো কিন্তু প্রথম বিশ্বের জন্য কল্যাণ কর নয়। তাই মানুষের অনুরুধের প্রেক্ষিতে আমি বিষয়টির ব্যাখ্যায় আমার নিজস্ব মতামত দিতে চাই। আমি বিশেষ কোন তৃতীয় বিশ্ববাদি দলের পক্ষে কথা বলতে পারিনা কিন্তু আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি। আমি এই বিষয়টিকে দুটি ভিন্ন পরিস্থিতে দেখতে চাই। এই বিষয়টি সম্পূর্ন ভাবে নির্ভর করছে তাঁর ক্ষমতা কাঠামো বা তাঁর ধরন ও প্রকৃতিটা কেমন তাঁর উপর।
প্রথম বিশ্ব জাতীয়তাবাদ
আমরা যখন প্রথম বিশ্ব কোন জাতীয়তাবাদি আন্দোলন দেখি, তখন সেখানে আমরা কি দেখতে পাই ? আমরা সেখানে বর্নবাদ ও গুষ্টিবাদের প্রবাল্য দেখতে পাই। এই সকল আন্দোলনের প্রান শক্তি প্রধানত বর্নবাদ কেন্দ্রীক হয়ে থাকে। এই ধরনায় যা লুকিয়ে থাকে তা হলো ‘আমাদের’ চেতনাই প্রধান আর আমরা যা গড়ে তুলেছি। যারা অভিবাসী বা শরনার্থী তাদেরকে দেখা হয় পর গাছা হিসাবে, বাহির থেকে যারা এসেছেন এরা সকলেই পর গাছা বিবেচিত হন। যারাই বহিরাগত সকলেই অপমানজনক পরিস্থিতির শিকার হন, কারন আমরা অন্যদের নিকট থেকে যা ছিনিয়ে এনেছি তা তাঁরা আমাদের কাছ থেকে আবার তা কেড়ে নিতে পারে। আমরা যখন প্রথম বিশ্বের কোন জাতীয়তাবাদি আন্দোলোনের কথা বলি তখন বুঝে নিতে হবে যে আমরা এক ধরনের উগ্রতার কথাই বলছি, নিজেদের প্রধান্যের ঘোষনা করছি, যদি ও মূখে ভালো ভালো কথা বলা হয় আদতে তা কোন ভাবেই জাতীয় গৌরবের কথা বলে না ।
জাতীয়তাবাদ, অবশ্যই, সামরিক কায়দায় প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বে তা তো সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে যুদ্বই করে চলেছে। চলমান যুদ্বের যথার্থতা প্রমান করবার জন্য আমরা যখন বলি আমরা দেশকে ভালোবাসি, তখন অন্য একটি দূর্বল দেশকে আক্রমন করা ও তাদের সম্পদ লুঠে আনাই আমাদের কর্ম হয়ে দাঁড়ায়। অথবা ‘আমরা যাদের বিরুদ্বে’ কোন অপরাধ করিনাই তাদের আক্রমনের প্রতিশোধ গ্রহন করা মওকা গ্রহন করি। আমাদের নিকট গুরুত্ব পূর্ন হলো ক্ষমতার স্বর্ন শিকরে আরোহন করা। প্রথম বিশ্বের মধ্যে একটি অহমিকা জন্ম নিয়েছে যে তারাই শ্রেস্ট, ইশ্বর তাদেরকে সারা দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দান করেছেন আর তাঁরা বলে দিবেন দুনিয়ার অন্য লোকেরা কিভাবে জীবন যাপন করবেন। এটা এখন বিশ্বাস করা হয় যে সরকার গুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করে বলে দেয়া হয় মানুষের জীবন প্রনালীর ধরন, যেমন- পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া গণতন্ত্র ইত্যাদি।
আমরা এখন মানবিকতার দোহাই ছাড়া কোন প্রকার অভিযান চালাই না । পুঁজিবাদের এখন আর সেই শক্তি ও নেই। পুঁজিবাদ কেবল লুন্ঠন, চুরি, ধর্ষন, এবং খুন খারাবী করতে পারে। এটা সাধারন কোন প্রকার ভালো কাজ ও করতে পারে না, যা করতে পারত তা ও করতে পারে না। পুঁজিবাদ কেবল সেই সকল জাতীকেই দখলে নিতে চায় যাদের নিকট থেকে কোন প্রকার বস্তুগত সুযোগ সুবিধা আদায় করতে পারবে। পুঁজিবাদী শ্রেনীর যদি মনে হয় যে কন দেশকে দকল করে তেমন কোন লাভ করতে পারবে না তবে তাঁরা সেই খানে নূন্যতম কোন ভূমিকা পালনে আগ্রহী নয়। রোয়ান্ডার গনহত্যার দিকে চেয়ে দেখুন, একটি দেশ ও সেই দিকে খেয়াল করলো না, কারন সেই দেশটি তাদেরকে তেমন কোন ভাবে লাভবান করতে পারবে না। কেবল মাত্র কানাডার জাতি সংঘে নিযুক্ত জেনারেল রোমারিও ডেল্লাইয়ার নিজে হস্তক্ষেপ করে সেই গনহত্যার রাশ টেনে ধরেন।
অথচ পুজিবাদ সেই দিকে খেয়ালই করল না, ইহা নূন্যতম সংহতী ও প্রকাশ করলো না ।
তৃতীয় বিশ্বে জাতিয়তাবাদ
আমরা যখন কোন তৃতীয় বিশ্বের দেশে জাতিয়তাবাদি আন্দোলন দেখি সেখানে আমরা কি দেখতে পাই? আমরা সেখানে দেখি তাঁরা কোন একটি দেশকে উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। ইহা কিন্তু কোন ভাবেই প্রথম বিশ্বের মত নয়। তাঁরা নিজেদের দেশের উপর অন্য দেশের নিয়ন্ত্রন উঠাতে তৎপর থাকেন। তাঁরা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার কায়েম করতে চায়। তাঁরা যখন নিজেদের জাতীয় গৌরবের কথা বলেন তখন তাঁরা কিন্তু নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে চেষ্টা করে থাকেন। জাতীয় মুক্তি মানেই তাদের কাছে অন্যের নিয়ন্ত্রনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা। তা কেবল প্রথম বিশ্বের নিকট থেকেই নয়, তা যে কোন ভিন্ন দেশের কবল থেকে মুক্তিকেই বুঝায়। আমরা যখন তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের কথা বলি তখন বুঝতে হবে যে আমরা তাদের নিজেদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চাইছি, অন্যের পরাজয় ঘটাতে চাইছি না ।
যখন ইহা তৃতীয় বিশ্ব হয় তখন তা এক ভিন্ন মাত্রা হিসাবে দেখা দেয়। তৃতীয় বিশ্বে জাতিয়তাবাদ সম্পূর্ন একটি আলাদা একটি বিষয়। কিন্তু কেন ? কেননা ইহার উৎপত্তি হয়েছে একটি বিশেষ বৈশ্বিক ক্ষমতা কাটামোর ভেতর থেকে। ইহা এসেছে নিপিড়িতদের নিকট থেকে, ইহা নিপিড়কদের নিকট থেকে বা দখলদারদের কাছ থেকে আসে নাই । জাতীয় গৌড়বের জন্য যে সংগ্রামের সূচনা হয় তা মুলত নিসৃত হয় নিপিড়কদের নিপিড়ন থেকে। ইহা হলো এক ধরনের নিরাপত্তা বলয় যা নিপিড়কদের নিকট থেকে একটি জাতিকে রক্ষা করতে পারে। তবে এটা প্রথম বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য নয়, এখানকার অভিবাসী বা শরনার্থীদের জন্য ও উপযোক্ত নয়। যখন কোন দেশ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে অন্যের উপর প্রভূত্ব কায়েম করতে চায় তখন তা প্রযোজ্য হয়। প্রথম বিশ্বের কোন দেশে এর জায়গা নেই, যেখানে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে জনগণকে মেরে ফেলতে পারে, চলমান ক্ষমতা কাঠামো এখন দুনিয়ায় একটি উল্লেখ যোগ্য পার্থক্য রেখা টেনে দিয়েছে।
সেই সকল ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ মুটামুটি একটি মানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যদি ও তা খুবই সীমিত পরিশরে। মাও বলেছিলেন জাতীয় বুর্জোয়ারা নিজেদের স্বার্থেই স্বাধীনতা চায়। তবে তাকে কিন্তু কোন ভাবেই সমাজতান্ত্রিক বলা যায় না। বড়জোড় তাঁরা সাময়িক ভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে লড়াই সংগ্রামে সমর্থন দেয়, যাকে আমরা প্রথমিক দ্বন্দ্ব বলতে পারি। ইহার অর্থ এই নয় যে পুঁজিবাদ ভালো জিনিষ, তবে এটা বলা যায় যে সাময়িক ভাবে পুজিবাদিদের একটি অংশকে তাদের অপর অংশের বিপরীতে লাগিয়ে দেয়া যায়। সাম্রাজ্যবাদের দখলদারীত্বের পর এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই ধরনের রনকৌশল ইতিহাসে মাওয়ের সাম্যবাদি বিপ্লবের সময় সত্য প্রমানিত হয়েছে। আসল কথা হলো, সাধারন ভাবে, জাতীয়তাবাদ হলো ক্ষমতা কাঠামোর একটি উপজাত বিষয়।
কিন্তু, কি ও যদি …?
প্রথম বিশ্বের দেশ সমূহ যারা পুঁজিবাদী তাঁরা অন্যন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশের সাথে যতটা সংহতি জানায় তার চেয়ে আক্রমণই বেশী করে থাকে । চালু ব্যবস্থাটির নাম পুঁজিবাদ। ‘শ্রমজীবী শ্রেনীর’ লোক সেই দেশে যতই থাকনা কেন তা পুঁজিবাদী দেশ পরোয়া করে না । শ্রমিকগন যতই নিপিড়িত জাতির সাথে একাত্ম হোক না কেন তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না, এমন কি তাদের আক্রমনের ধরন ও পাল্টায় না । পুঁজিবাদের আক্রমনে বা দখলের ক্ষেত্রে কোন প্রকার মানবিকতার জায়গা নেই।
দখলদার দেশ যদি হয় সমাজতান্ত্রিক তা হলে কি হয়? তবে ইহা কিন্তু কোন ভাবেই পুজিবাদিদের মত হবে না । যদি ও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে, তবে তা অবশ্যই হবে মানবিক প্রকৃতির। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ থেকে সত্যিকের মুক্তির দিক গুলো অবশ্যই আলাদা ধরনের হতে বাধ্য।
উপসংহার
মাও বলেছিলেন, “ বিদ্রোহের অধিকার সকল সময়েই বৈধ”। কিন্তু নিপিড়নের মাত্রা অবশ্যই চূড়ান্ত ও অসহনীয় হবে এবং তা ক্ষমতা কাঠামো থেকে উৎসারিত হতে হবে।